১১/১৭১২০১৫
"বৈদিক যুগে
গরু
অবধ্য
ছিল
না, পবিত্রও
ছিল
না" - ফ্রন্টলাইন
ঐতিহাসিক
ডি.এন.ঝা
এর
সাক্ষাতকার
অজয়
আশির্বাদ
মহাপ্রশস্ত
প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয়
ভারতের ঐতিহাসিক এবং, (Holy Cow ) পবিত্র গোরু: ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসে গোমাংস ও (The Myth of the Holy Cow)
পবিত্র গোরু সম্পর্কে
অতিকথন গ্রন্থের লেখক ঐতিহাসিক ডি.এন.ঝা এর সাক্ষাতকার। নিয়েছেন অজয় আশির্বাদ মহাপ্রশস্ত।
গো-হত্যা এবং গোমাংস ভক্ষন আবারও এক রাজনৈতিক ঘূর্ণীঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে
অবস্থান করছে। হিন্দুত্ববাদীরা
সরকারের সহায়তায় গোটা দেশব্যাপি গো-রক্ষণ কর্মসূচি
গ্রহণ করতে পেরেছে সাফল্যের সাথে এবং গরুকে রাজনৈতিক প্রতিক হিসাবে ব্যাবহার করে হিন্দু আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মেরু করণ ঘটাতে সচেষ্ট।
ফ্রন্টলাইন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক
ডি.এন.ঝা
এর সাথে কথা বলেছে যিনি প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস এবং শতাব্দীব্যাপি
ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসের এবং এতে গরুর স্থান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। ঝা প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয়
ভারতের উপর অসংখ্য বই
লিখেছেন।
তাঁর বই পবিত্র গোমাতা:
ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসে গোমাংস(২০০২)
এবং পবিত্র গোমাতা বিষয়ে অতিকথন(২০০৯) সুবিশাল ঐতিহাসিক তথ্যভাণ্ডারকে
টেনে এনে প্রমাণ করেছে প্রাচীন ভারত থেকেই গোমাংস ভক্ষণের রীতি প্রচলিত ছিল, এটা হিন্দুত্বের এই মিথকে খণ্ডন করেছে যে
ইসলামী শাসনকালে ভারতে গোমাংস ভক্ষণ প্রচলিত হয়। তাঁর বই বিরাট বিতর্কের সৃষ্টি করে আর ইতিহাসকে
তুলে ধরার জন্য হিন্দু উগ্রপন্থীরা তাকে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কি
ভাবে গোমাতা মিথ আর
গোমাংস ভক্ষণের বিষয়টি হিন্দু উগ্রপন্থীরা জাতীয় স্মৃতিতে
খুঁচিয়ে তুলেছে আর তাদের ইতিহাস বিকৃতি-করনের বৃহত্তর রাজনৈতিক
স্বার্থ কি। তাঁর ইমেইল সাক্ষাতকার থেকে নেওয়া অংশ।
কি কারণে প্রাচীন ভারতের খাদ্যাভ্যাসের উপর গবেষণায় আপনাকে হাত দিতে হল? আপনার বইতে গো-মাংস ভক্ষণ কেন এমনভাবে কেন্দ্রীয় বিষয় বস্তু হল?
যেহেতু আমি হিন্দু আত্মপরিচয় আর খাদ্যাভ্যাসের সাথে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম, সে কারণে আমি প্রাচীন ভারতের খাদ্যাভ্যাসের গবেষণায় হাত দিই। আমার পঠন-পাঠনের ফলে আমি খুঁজে পেলাম তাতে গোমাংস ভক্ষণের উপর যথেষ্ট তথ্য আছে যা আমি একত্রিত করতে পারি। তাছাড়াও, সে সময়ে NDA1 (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ছিল আর NCERT ( ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং) এর গোমাংস ভক্ষণের উল্লেখ নিয়ে বিতর্ক চলছিল। এটাই আমায় উৎসাহিত করে প্রামাণ্য তথ্য সমূহ বইয়ের আকারে একত্রিত করে পাঠককুলের হাতে তুলে দিতে। সে কারণেই গোমাংস ভক্ষণের ইতিহাস বইটির কেন্দ্রীয় বিষয় বস্তু হয়েছে। কিন্তু আপনি যদি বইটা পড়েন, আপনি প্রমাণ পাবেন সে সময়ে অন্যান্য জীবদের মাংস ভক্ষণেরও প্রচলন ছিল।
কৃষি অর্থনীতিতে গরুর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রাচীন ভারতে গরু বলি দেওয়ার বা গো-হত্যা করার কি কোন অর্থনৈতিক যুক্তি ছিল?
পশু বলি দেওয়া অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকেই ব্যাখ্যা করা যায়। আপনি জানেন, ইন্দো-ইউরোপিয়ানরা ভারতে খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দে প্রবেশ করে, এবং তারা সাথে করে এনেছিল বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় বৈশিষ্ঠ যেমন, মেষপালকের চরিত্র, প্রাথমীক ধরনের কৃষি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পশু বলি সহ বিভিন্ন আচার। তারা সাথে করে বিভিন্ন ইন্দো-ইরানীয় দেবতাকেও নিয়ে এসেছিল, যেমন, ইন্দ্র, অগ্নি, সোম যাদের জন্য বলিদান করা হত। বর্তমান কৃষি প্রচলিত হয়নি তখনোও, ফলে, গবাদি সহ, পশু বলি দান, খাদ্য এবং বলিদান উভয় প্রয়োজনকেই সেবা করতো। দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রর বিশেষ পছন্দ ছিল ষাঁড় এবং মোষ, আর মানুষের মধ্যে সম্মানীয় ঋষি মিথিলা আর যাজ্ঞবল্ক্য গোমাংস পছন্দ করতেন।
বৈদিক এবং পরবর্তী যুগের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আর কোন ঐতিহাসিক কাজ করছেন কি? ডী.ডী. কোসাম্বী তাঁর বই প্রাচীন ভারতে লিখেছেন ব্রাহ্মণরা গোমাংস ভক্ষণ করত।
আর.এল. মিত্র প্রথম ভারতীয় বিশেষজ্ঞ যিনি বৈদিক যুগে গোমাংস ভক্ষণের অভ্যাসের ব্যাপারে লিখেছেন। পি.ভি.কানে, ডী.ডী. কোসাম্বী সহ আরও অনেক বিশেষজ্ঞ এটা উল্লেখ করেছেন। ফলে গো-বলি দান আর গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে আমিই প্রথম লিখছি না। কিন্তু অন্য বিশেষজ্ঞদের সাথে ফারাক এই যে আমি যুক্তি দিয়েছি যে, বৈদিক যুগের পরেও গোমাংস ভক্ষণ ভারতীয় ঐতিহ্যের অংশ ছিল। এর বহু প্রমাণ বর্তমান।
আপনি কি ঐতিহাসিক কোন গ্রন্থ থেকে কোন উদ্ধৃতি দিতে পারেন, আপনার গবেষণা অনুযায়ী, যা এটা পরিষ্কার করবে প্রাচীন ও মধ্য যুগের ভারতে গোমাংস ভক্ষণ স্বাভাবিক আচার ছিল? প্রাচীন ভারতীয় অনেক গ্রন্থে এমন অনেক উদ্ধৃতি রয়েছে যা গো-অর্চনাকে প্রমাণ করে?
আমার বই The Myth of the Holy Cow তে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি, গো-মাংস ভক্ষণ ইসলামের "দূর্ভাগ্যজনক অবদান" নয়, বরং বৈদিক যুগে এটা সাধারণ আচার ছিল। দেবতার কাছে বলিদান থেকে শুরু করে এর বহু প্রমাণ রয়েছে। এগুলো বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগের লেখা থেকে পাওয়া যায়। ঋক বেদের এক জায়গায় (X.86.14), বৈদিক দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্র এমন বলছেন বলে বর্ণনা আছ, " তারা আমার জন্য পনেরো এবং কুড়িটি ষাঁড় রান্না করেছে"। অন্য জায়গায় উল্লেখ আছে তিনি ষাঁড়ের মাংস
খাচ্ছেন(X.28.3),
একটি(X27.2), একশটি মহিষ(VI.17.11), তিনশটি মহিষ(V.29.7), বা সহস্রটি মহিষ(VIII.12.8)। অগ্নির জন্যও গবাদি পশু
বলি দেওয়া হতো, ঋক বেদে যার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে "ষাঁড় আর বন্ধ্যা গাভী যার খাদ্য"(VIII.43.11)। বেদের পরবর্তী যুগের
লেখাতেও এমন বহু উদাহরণ আছে আর তার একটি হল, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ(III.9.8), তাতে সংশয়হীন ভাবে
দেখানো আছে উৎসর্গ করা গাভীর হত্যা মূলত খাদ্য। বিভিন্ন লেখায়,
বিশেষ করে
গোপথ ব্রাহ্মণে (I.3.18)
দেখানো
হয়েছে উৎসর্গীকৃত জীবটি মূলত মানুষের খাদ্য। মৃত পশুর মাংসকে ছত্রিশ ভাগ করার কথা
বলা হয়েছে।
সাধারণ ঘরোয়া প্রয়োজনেও
গবাদি পশু হত্যা করা হত। একটা ঋক বৈদিক স্তোত্রে(X.85.13) পাওয়া যায় বিবাহের
অনুষ্ঠানে গো-হত্যা করা হত। পরবর্তীতে
ঐতিরীয় ব্রাহ্মণে(III.4)
বলা হয়েছে
রাজা বা সম্মানীয় কোন অতিথি বাড়িতে এলে মানুষ গো হত্যা করে।
গুরুত্বপূর্ণ অতিথীকে
আপ্যায়ন করার অনুষ্ঠানে (মধুপর্ক) গো-হত্যা করা হত। এটা বৈদিক এবং পরবর্তী যুগের লেখায় বারবার এসেছে। আক্ষরিক অর্থে
"মধুপর্ক" এর উল্লেখ প্রাচীন ভারতের অনেক উত্তরকাল অবধি
পাওয়া যায়। গবাদি হত্যা মৃতদের অর্চনার সাথেও গভীর ভাবে যুক্ত ছিল। শ্রদ্ধার
সন্তুষ্টির মাত্রা নির্ভর করত কি পশু উৎসর্গ করা হয়েছে তার উপর। অপাষ্ঠম্ভ ধর্ম-সূত্র বলে কিভাবে গোমাংস পিতৃ পুরুষদের (মৃত পূর্ব পুরুষদের) এক বছরের জন্য সন্তুষ্টি বিধান করে। ফলে,
সন্দেহাতীত
ভাবেই বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগে গোহত্যা আর গো-মাংস ভক্ষণ অতি সাধারণ বিষয় ছিল। বৃহদারন্যক উপনিষদ(VI.4.18) এমন কি এভাবে বলেছে,
যে ব্যক্তি
জ্ঞানী পুত্র সন্তান লাভ করতে চান, তিনি যেন গোমাংস বা সে
জাতিয় মাংস ঘি আর ভাত দিয়ে আহার করেন।
গো-হত্যা আর গোমাংস ভক্ষণের যেমন উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রয়েছে,
তেমন এ
উদাহরণও বর্তমান গরুকে সম্পদ হিসাবে গণ্য করা হত এবং তার জন্য যুদ্ধও করতো বৈদিক মানুষেরা।
বৈদিক বিশেষজ্ঞ মিশেল উইজেল যেভাবে উল্লেখ করেছেন, এটা পছন্দ ছিল অদিতি (দেবতা গনের মাতা, আক্ষরিক অর্থে অন্তহীন
স্বর্গ),
পৃথিবী,
মহাজাগতিক
বারির (ইন্দ্র যাকে মুক্ত করে
মহাজাগতিক সূত্র(রত), মাতৃত্ব, আর কাব্য(বাক) প্রতিষ্ঠা করেন, এতে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য ছিল)। আমাদের বলা হয়ে থাকে গাভী শব্দটা রূপক ও সম গোত্রীয় কিছু বোঝাতে
ব্যবহৃত হয়েছে পুনঃপুন। একে সময়ের সাথে মিলিয়ে শব্দার্থ করতে হবে বলে বিতর্ক করা
হয়। কিন্তু বৈদিক যুগে গোরু কোন
ভাবেই অবধ্য বা পবিত্র ছিল না।
তাহলে বর্তমানে সংঘ
পরিবারের কর্মসূচি কি একটি বৈষম্য-পূর্ণ বিষয় না সুবিধাবাদী পুনরুত্থান ? তাদের ভাবধারার একজন,
কে.আর.মালকানি প্রকাশ্যে গোমাংস ভক্ষণ সমর্থন করেছেন।
গোরু বিষয়ে সংঘ পরিবারের
মতামত নীতি হীন এবং ভণ্ডামি পূর্ণ। তাদের এক সময়কার মতাদর্শ-গত নেতৃত্ব কে.আর.মালকানি ১৯৬৬ সালের আগেই
বিকৃতি-হীন ভাবে বলেছিলেন
স্বাভাবিক ভাবে মৃত গরুর মাংস খাওয়া যেতে পারে। এটা কি ভাবে সংঘ পরিবারের জাতীয়
স্তরে সম্পূর্ণ ভাবে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করার
দাবির সাথে সংগতিপূর্ণ হয়?
গোরু,
হিন্দু
অধিকারের এক বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। আপনি ঐতিহাসিক ভাবে এটার কি ব্যাখ্যা
করবেন? গোরু কোন সময় থেকে "পবিত্র" হল, আর এটা কি ভারতের
ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার সূচনার সাথে যুগপৎ? কোন কোন ঐতিহাসিক এটা
দেখিয়েছেন যে ঊণবিংশ শতকের শেষ ভাগে গোরুর সাম্প্রদায়িকিকরণ হয়েছে।
প্রাপ্ত প্রমাণ গুলি এটা
নির্দেশ করে যে মৌর্য পরবর্তী যুগ থেকে গোহত্যার বিষয়ে ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিভঙ্গি
পাল্টাতে শুরু করে। এটা অর্থনৈতিক আর ধর্মীয় বিকাশ উভয় দিক দিয়েই ব্যাখ্যা করা
যায়। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার, এসময় থেকে ব্রাহ্মণদের
লেখাগুলি বারংবার বলতে শুরু করে যে কলি যুগে গোহত্যা অনুমোদন যোগ্য নয়। এটা গোরুকে
একটা বিশেষ স্থান দেয় আর একে অবধ্য তে পরিণত করে।
সে কারণে,
এই পশুর
অবধ্যতা ব্রাহ্মণ্য মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। মধ্য যুগের সূচনা পর্বে
গো-মাংস ভক্ষণ অস্পৃশ্য
বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয় এবং বিশ্বামিত্রি(I.12) স্পষ্ট ভাবে বলে একজন গো-হত্যাকারী অস্পৃশ্য। কিন্তু মধ্য যুগে গো-হত্যা মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সংযুক্ত করে,
তাদের গো-মাংস ভক্ষণকারী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। সে
সময়ে কদাচিৎ গো-সম্পর্কিত উত্তপ্ত
পরিস্থিতি সৃষ্টি হত। আমি এই ভাবনায় উপনীত হয়েছি যে, মধ্য যুগে গরু
ব্রাহ্মণ্য বৃত্তের ভিতর ধর্মীয় সংবেদনশীলতার প্রতীকে পরিণত হতে শুরু করলেও,
মারাঠা
সাম্রাজ্য আর শিবাজির সময়ে এটা আরও বেশি সংবেদনশীল বিষয়ে পরিণত হয়। শিবাজীকে গো-ব্রাহ্মণের রক্ষাকর্তা হিসাবে ভাবা হত। কিন্তু
ঊণবিংশ শতকের শেষ ভাগে শিখদের কুকা আন্দোলন এই প্রাণীকে প্রথম রাজনৈতিক গণ জাগরণের
কাজে ব্যবহার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। প্রায় একই সময়ে, ১৮৮২ সালে,
দয়ানন্দ
সরস্বতী গোরক্ষিনি সভা তৈরি করেন। তিনি এটা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিবিধ মানুষকে
ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যবহার করেন। এটা সূচনায় ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শ আর এখন এটা
হিন্দু পরিচয়ের প্রতিকে পরিণত হয়েছে।
সংঘ পরিবার কখনো ভারতের পেশাদার ঐতিহাসিক লেখা আর তার সিদ্ধান্ত সমূহকে অস্বীকার করে। তারা বলে ভারতের ঐতিহাসিকরা পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকদের দ্বারা ভীষণ ভাবে প্রভাবিত তাই তারা ভারতের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে সঠিক ভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা ভারতীয় ঐতিহাসিকদের "ম্যাকাউলি আর মার্ক্সের সন্তান" বলে অভিহিত করেছে। আপনার মতামত।
ভারতের পেশাদার ঐতিহাসিকদের লেখা খণ্ডন করা, সংঘ পরিবারের ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য ইতিহাস-বিদ্যা সম্পর্কে তাদের অপরিসীম অজ্ঞতাকে প্রমাণ করে। আপনি যদি ভারতের ইতিহাস লেখার প্রবণতার দিকে দেখেন, বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে, এটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে যে ভারতীয় ঐতিহাসিকরা ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস চর্চার মূল ধারাকেই অত্যন্ত কার্যকর-ভাবে প্রশ্ন করেছেন আর ভারতের অতীতকে বোঝার এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছেন। অন্য দিকে সংঘ পরিবারের দিকে দেখুন, যারা ভারতের ইতিহাসের হিন্দু আর মুসলিম যুগের কাল বিভাগকে আঁকড়ে ধরে আছে। এটা প্রথম জেমস মিল চালু করেছিলেন। তাহলে আমরা এর সদস্যদের জেমস মিলের সন্তান বলতে পারি না?
সংঘ পরিবার প্রাচীন ভারতীয় আচার গুলিকে মিথ্যা ভাবে মহিমান্বিত দেখানোর চেষ্টা করছে, আর মধ্য যুগকে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এরা দুটি যুগকে হিন্দু আর মুসলিম শাসনের নিরিখে দেখে। আপনার মতে এই ভাবে বিভাগ করার সমস্যা কি?
ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু আর মুসলিম যুগে ভাগ করার ভিত্তি হল এটা ধরে নেওয়া যে আগেকার যুগে সমস্ত শাসকরাই হিন্দু ছিলেন, আর পরবর্তী যুগের সমস্ত শাসকরা মুসলিম ছিলেন। কিন্তু এটা সত্য নয়। প্রাচীন ভারতে কোন হিন্দুত্ব বা হিন্দু ছিল না। প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে পরিচিত শাসক, অশোক, বৌদ্ধ ছিলেন, হিন্দু ছিলেন না। একই ভাবে পরবর্তী যুগের সমস্ত শাসকই মুসলিম ছিলেন না। চোলরা মুসলিম ছিল না!
এই ভাবে যুগ বিভাগ ভারতের ইতিহাস লেখার সাম্প্রদায়ীকি করণ করেছে। এটা হিন্দু যুগকে অসংগত ভাবে মহিমান্বিত করেছে, আর মুসলিম যুগকে অবিচারে হীন প্রতিপন্ন করেছে। অনেক ভালো যুগ বিভাগের পদ্ধতি আসতে পারে, সামাজিক, অর্থনৈতিক ( কারিগরি-গত ভাবেও), আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ঐতিহাসিক বাঁক-মোড় গুলির নিরিখে, ভাগ্যের নিরিখে/ কাকতালীয় ভাবে পাল্টানো শাসক বংশের নিরিখে না দেখে। এটা একটা বিশাল যুগ ধরে সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়গুলিকে পরিষ্কার ব্যাখ্যা করতে পারে।
জাতীয়তাবাদী কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রের NDA সরকার ব্রিটিশ যুগ বা ঔপনিবেশিক যুগের চর্চার উপর কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেন?
NDA সরকারের জাতীয়তাবাদ এক ধরনের ভণ্ডামি। এরা কখনো কোন ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামে অংশ নেয়নি। আর যখন এরা করেছে, এদের অত্যন্ত সম্মানীয় নেতা, "বীর" সাভারকার, এতটাই বীর (সাহসী) ছিলেন যে তিনি ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এখন যারা সত্যিই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, তাদের ঐতিহ্যকে মুছে ফেলা হচ্ছে বা খাটো করে দেখানো হচ্ছে। মনে করে দেখুন, সুব্রমানিয়াম স্বামী কিভাবে "নেহেরুভিয়ান" ঐতিহাসিকদের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছিলেন।
সারা বিশ্বের পেশাদার ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটা সাধারণ ঐক্যমত্য আছে, ব্যক্তিত্ব, অর্থনীতি, সমাজ প্রভৃতি যে কোন ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রে, সে সময়ের রাষ্ট্র চরিত্র মাথায় রাখা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কোন ঐতিহাসিক ঘটনার পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট বিচার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিভাত হয়। যদিও, সংঘ পরিবারের ইতিহাসের ধরণ বাঁক নিচ্ছে, যাকে বলা যায় " প্রেক্ষাপট বিহীন ব্যক্তিত্বের ইতিহাস"। ইতিহাসের এমন জীবনী মূলক রাস্তায়, শাহজাহান, ঔরঙ্গজেব, গজনীর মুহম্মদ ঘোরি খল-নায়ক হয়ে গেছে, আর মহারাণা প্রতাপ, পৃথ্বীরাজ চৌহানের মত হিন্দু শাসকদের নায়ক হিসাবে দেখানো হয়েছে। আপনার কি মনে হয় এই ধরনের ইতিহাসের মধ্যে কোন নিয়ামক সমস্যা বর্তমান?
এটা আপনার আগের প্রশ্নে আমার উত্তরের সাথে সম্পর্কিত। কোন শাসকের বিচার হওয়া উচিত তার সময়কালের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর অন্যান্য অগ্রগতির নিরিখে। প্রেক্ষাপট বিহীন ইতিহাস থেকে পৃথ্বীরাজ চৌহান, মহারাণা প্রতাপের মত ব্যক্তিত্বদের মহিমান্বিত করা হবে, আর যে মুসলিম শাসকরা যুদ্ধে এদের পরাস্ত করেছিলেন, তাদের দানবী করণ হবে।
হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা তাদের ইতিহাসের ধরনের সাপেক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলে, পেশাদার ঐতিহাসিকরা মতাদর্শ-গত ভাবে হিন্দুত্ব বিরোধী। তারা কখনো হিন্দুত্বের ঐতিহ্যের সাথে সমন্বয়সাধন ধর্মী গবেষণা করেনি। তারা অন্যান্য ধর্মের ঐতিহ্যের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। এটা কি সত্য?
এটা সত্যের অপলাপ। ভারত ও বাইরের পেশাদার ঐতিহাসিকরা প্রাচীন আর মধ্য যুগের ভারতের ধর্মীয় সমন্বয় সাধনের উপর যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছেন। ডী.ডী. কোসাম্বী, আর.এস.শর্মা, রোমিলা থাপার, গুন্টার দিয়েৎস শনথইমার আরও অসংখ্য বিশেষজ্ঞরা ভারতের ধর্মীয় সমন্বয় সাধনের বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু হিন্দুত্বের ব্রতীরা পড়ে না, তারা শুধু চিৎকার করে। তারা একদল অজ্ঞতা-বিলাসী।
Comments
Post a Comment